আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট ছেলে না মেয়ে বোঝার উপায়

প্রিয় পাঠকগর্ভাবস্থায় আলট্রাসনোগ্রাফি পরীক্ষা নিয়ে অনেকের মনে অনেক প্রশ্ন থাকে। এই পরীক্ষাটি কীভাবে করা হয়, কখন করা হয়, কী দেখা হয়, শিশু ছেলে না কি মেয়ে সেটা বোঝা যায় কি না,পরীক্ষাটি গর্ভের শিশুর জন্য নিরাপদ কি না সাধারণত এসব বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসা থাকে। এই প্রশ্নগুলো নিয়ে এই আর্টিকেলে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট ছেলে না মেয়ে বোঝার উপায়

ভূমিকা

বাংলাদেশে সন্তান জন্মের আগে গর্ভস্থ সন্তান ছেলে না মেয়ে, তা নিয়ে উদ্বেগে থাকে অনেক পরিবার। দেখা যায়, লিঙ্গ পরিচয় জানতে আল্ট্রাসনোগ্রাম করানোর সময় মেয়ে সন্তান হবে এমনটা জানলে অনেক পরিবারের সদস্যই আশাহত হন বা ভেঙ্গে পড়েন।এমন কী সে সব ক্ষেত্রে গর্ভবতী মা শ্বশুরবাড়িতে শারীরিক, মানসিক বা নানা ধরনের অত্যাচারেরও শিকার হয়, যা তার প্রেগন্যান্সিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে।

আল্ট্রাসনোগ্রাম কি এবং কেন প্রয়োজন

  • আল্ট্রাসনোগ্রাম একটি মেডিক্যাল ইমেজিং টেকনোলজি। এটি শব্দ তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের ভেতরের ছবি তুলে। গর্ভাবস্থায় এটি ভ্রুণের অবস্থা দেখতে সাহায্য করে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন রোগ নির্ণয়ে এটি ব্যবহৃত হয়।
  • গর্ভাবস্থার সময় ভ্রুণের বিকাশ দেখা যায় আল্ট্রাসনোগ্রামে। এটি ভ্রুণের স্বাস্থ্য যাচাই করতে সাহায্য করে। শিশুর লিঙ্গ নির্ধারণ করতেও এটি ব্যবহৃত হয়। মায়ের গর্ভের অবস্থা জানার জন্যও এটি গুরুত্বপূর্ণ।
প্রথম আলট্রাসনোগ্রাফি

প্রথম গর্ভকালীন চেকআপের সময়ে আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। ডাক্তার আপনাকে সাধারণত গর্ভাবস্থার ১০–১৪তম সপ্তাহে প্রথম আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দিবেন। এই সময়ে পরীক্ষা করালে সাধারণত সঠিক ফলাফল পাওয়া যায়। গর্ভধারণের পর বেশি আগেভাগে আলট্রাসনোগ্রাফি করালে সঠিক ফলাফল না-ও আসতে পারে।

প্রথম স্ক্যানে বেশ কিছু তথ্য উঠে আসে। যেমন: ভ্রূণ জরায়ুতে ঠিকমতো বসেছে কি না। ভ্রূণ অবস্থায় শিশু জরায়ুর বাইরে নিজেকে গেঁথে নিলে তাকে এক্টোপিক প্রেগন্যান্সি বলা হয়। এক্ষেত্রে শিশুটি বাঁচতে পারে না। দ্রুত সঠিক চিকিৎসা না নিলে মায়ের জীবনও হুমকির মুখে পড়তে পারে।প্রথম স্ক্যান থেকে উঠে আসা অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের মধ্যে রয়েছে আপনি কত সপ্তাহের গর্ভবতী
  1. ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ কবে
  2. গর্ভে যমজ বা একাধিক শিশু আছে কি না
  3. গর্ভের শিশু ঠিকমতো বেড়ে উঠছে কি না
  4. এ ছাড়া শিশুর কিছু শারীরিক অবস্থা নির্ণয় করা যায়। যেমন: মেরুদণ্ড ঠিকমতো বন্ধ না হওয়া (স্পাইনা বিফিডা)
  5. বিশেষ তথ্য: আলট্রাসনোগ্রাফির সাহায্যে ডাউন সিনড্রোম পরীক্ষা
  • গর্ভের শিশু যদি ‘ডাউন সিনড্রোম’ এর ঝুঁকিতে থাকে যেমন: গর্ভধারণকালে মায়ের বয়স বেশি হওয়া, বংশগত কারণ এবং মায়ের অপর কোনো সন্তানের ডাউন সিনড্রোম থাকা—তাহলে ডাক্তার ১০–১৪তম সপ্তাহের স্ক্যানের সময়ে বিশেষ পদ্ধতিতে আলট্রাসনোগ্রাফি করার পরামর্শ দিতে পারেন।
  • এক্ষেত্রে সাধারণ সব তথ্যের পাশাপাশি শিশুর ঘাড়ের কাছে থাকা তরলের পরিমাণ মেপে দেখা হয়। এই পদ্ধতিকে ডাক্তারি ভাষায় Nuchal Translucency Scan বলা হয়। এই সময়ে আলট্রাসনোগ্রাফির পাশাপাশি মায়ের রক্তের বিশেষ (ডিএনএ) পরীক্ষা করে ডাউন সিনড্রোমের ঝুঁকি নির্ণয় করা হয়।
দ্বিতীয় আলট্রাসনোগ্রাফি

গর্ভাবস্থার ১৮–২২তম সপ্তাহে দ্বিতীয় আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। একে অনেকসময় ‘অ্যানোমালি স্ক্যান‘ বলা হয়। গর্ভাবস্থায় অন্তত একবার আলট্রাসনোগ্রাফি করালেও এই সময়ে করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার সময়ে শিশুর মুখমণ্ডল, হাত-পা, পেট ও নাড়িভুঁড়ি, হাড়, হার্ট, কিডনি, ব্রেইন ও স্নায়ুতন্ত্র খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা হয়। 
  1. এই স্ক্যানে অনেকগুলো তথ্য পাওয়া যায়। যেমন গর্ভের শিশুর কোনো ধরনের জন্মগত ত্রুটি বা ‘অ্যানোমালি’ আছে কি না
  2. শিশুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে গড়ে উঠছে কি না
  3. শিশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক হারে চলছে কি না
  4. গর্ভের শিশুর আকার ও ওজন
  5. শিশু ছেলে না কি মেয়ে। এই তথ্য জানতে চাইলে স্ক্যানের শুরুতে ডাক্তারকে জানিয়ে রাখবেন। তবে মনে রাখবেন, শিশুর অবস্থানসহ বিভিন্ন কারণে শিশুর লিঙ্গ বুঝে ওঠা সম্ভব না-ও হতে পারে
তৃতীয় আলট্রাসনোগ্রাফি
গর্ভাবস্থার ৩৬–৩৮তম সপ্তাহে তৃতীয় আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। এই স্ক্যানে প্রসবের আগে গর্ভের শিশু ও গর্ভফুলের অবস্থান দেখে নেওয়া হয়। এই স্ক্যান ডেলিভারির জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে ডাক্তারদের সাহায্য করে। এসময়ে দেখা হয়—গর্ভফুল বা প্লাসেন্টার অবস্থান। প্লাসেন্টার অবস্থান স্বাভাবিকের চেয়ে নিচে নেমে আসলে ।
  • ‘প্লাসেন্টা প্রিভিয়া’ নামক মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে সিজারের সাহায্যে ডেলিভারিসহ বিশেষ প্রস্তুতির প্রয়োজন হতে পারে
  • গর্ভের ভেতরে শিশু লম্বালম্বি, আড়াআড়ি অথবা কোণাকুণি—কোন অবস্থানে আছে। নরমাল ডেলিভারির জন্য উপযুক্ত অবস্থানে না থাকলে নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতির সাহায্যে শিশুর অবস্থান পরিবর্তনের চেষ্টা করা হতে পারে। অন্যথায় সিজারের প্রয়োজন হতে পারে।
  • গর্ভের শিশুর চারপাশে থাকা ‘অ্যামনিওটিক তরল’ এর পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করা হয়৷ এটি পরিমাণে বেশি বা কম হলে গর্ভাবস্থায় জটিলতা দেখা দিতে পারে এবং ডেলিভারির সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলতে পারে
  • এ ছাড়া শিশু গর্ভের ভেতর ঠিকমতো নড়াচড়া করছে কি না সেটাও দেখা হয়

ছেলে না মেয়ে বোঝার সাধারণ পদ্ধতি

আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টের মাধ্যমে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। এই পদ্ধতিতে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণে নির্ভুল ফলাফল পাওয়া যায়।

লিঙ্গ নির্ধারণের চিহ্ন
  • আল্ট্রাসনোগ্রামে লিঙ্গ নির্ধারণের চিহ্ন দেখা যায়। ছেলে হলে পেনিস এবং মেয়ে হলে ভ্যাজাইনা দেখা যায়। সাধারণত ১৮-২০ সপ্তাহের পর লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়।
অঙ্গ প্রত্যঙ্গের অবস্থা
  • ছেলে শিশুর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ স্পষ্টভাবে দেখা যায়। মেয়ে শিশুর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ কম স্পষ্ট হয়। পেটের অবস্থান থেকেও কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়।
আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট বিশ্লেষণ
  1. আল্ট্রাসনোগ্রাম ছবিতে শিশুর যৌনাঙ্গ স্পষ্ট দেখা যায়। ছেলে হলে, লিঙ্গ দেখা যাবে। মেয়ে হলে, যৌনাঙ্গের ফাঁক দেখা যাবে। ছবির গুণগত মান ভালো হলে, সহজে বোঝা যায়। ডাক্তারের অভিজ্ঞতা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
  2. পরীক্ষার ফলাফলে শিশুর যৌনাঙ্গের বিবরণ থাকে। ছেলে হলে, পুরুষাঙ্গের উপস্থিতি উল্লেখ থাকে। মেয়ে হলে, যোনির উপস্থিতি উল্লেখ থাকে। ডাক্তারের মন্তব্য রিপোর্টে থাকে। ফলাফলে অতিরিক্ত তথ্য থাকতে পারে।
ভুল ধারণা এবং বাস্তবতা
অনেকেই মনে করেন আল্ট্রাসনোগ্রাম দিয়ে লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। এটি একটি ভুল ধারণা। আল্ট্রাসনোগ্রাম মূলত গর্ভের শিশুর অবস্থা দেখার জন্য। লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য এটি তথ্যপূর্ণ নয়। কিছু লোক গুজব ছড়ায় যে কিছু বিশেষ লক্ষণ দেখে লিঙ্গ নির্ধারণ করা যায়। এটি বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই।
বাংলাদেশে লিঙ্গ নির্ধারণ করা আইনত নিষিদ্ধ।

আইন অনুযায়ী, আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে লিঙ্গের উল্লেখ করা যায় না। এই আইন লিঙ্গ বৈষম্য রোধ করার জন্য। চিকিৎসকরা লিঙ্গ নির্ধারণের জন্য আল্ট্রাসনোগ্রাম ব্যবহার করতে পারেন না। এটি করলে আইন ভঙ্গ হয়।

আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টের নির্ভরযোগ্যতা

আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট সাধারণত নির্ভুল হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ভুল হতে পারে। সঠিক নির্ণয়ের জন্য অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ান দরকার। আল্ট্রাসনোগ্রাম মেশিনের মানও গুরুত্বপূর্ণ। কিছু সময়ে রিপোর্টে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।বিশেষজ্ঞরা বলেন, আল্ট্রাসনোগ্রাম নির্ভরযোগ্য। তবে সবসময় ১০০% সঠিক নয়। কিছু ক্ষেত্রে ভুল তথ্য পাওয়া যায়। সঠিক রিপোর্টের জন্য অভিজ্ঞ ডাক্তার দরকার।

বিকল্প পদ্ধতি এবং প্রযুক্তি
  • আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট থেকে ছেলে বা মেয়ে বোঝার প্রযুক্তি প্রায়শই নির্ভুল তথ্য প্রদান করে। বিকল্প পদ্ধতির সাহায্যে গর্ভকালীন সময়ে সন্তানের লিঙ্গ নির্ধারণ করা সহজ হয়।
এমআরআই এবং সিটি স্ক্যান
  • এমআরআই এবং সিটি স্ক্যান শরীরের অভ্যন্তরীণ ছবি তৈরি করে। এগুলো অঙ্গের গঠন এবং বিকাশ পর্যবেক্ষণ করতে সহায়ক। গর্ভাবস্থায় এমআরআই নিরাপদ। তবে সিটি স্ক্যান বিরল ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিগুলো লিঙ্গ নির্ধারণে ব্যবহৃত হয় না।
গর্ভাবস্থায় জিনগত পরীক্ষা
  1. গর্ভাবস্থায় জিনগত পরীক্ষা লিঙ্গ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ। এই পরীক্ষাগুলো ডিএনএ বিশ্লেষণ করে। এতে সন্তানের লিঙ্গ এবং জিনগত অবস্থা জানা যায়। অ্যামিনোসেন্টেসিস এবং সিভিএস এই পরীক্ষার উদাহরণ। এগুলো গর্ভাবস্থার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে করা হয়।
আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টের সামাজিক প্রভাব
  • আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্টে লিঙ্গ নির্ধারণের সামাজিক প্রভাব বিবেচনা করা উচিত। রিপোর্টে লিঙ্গ নির্ধারণের প্রভাব উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। এটি পরিবারে পরিকল্পনা করা উচিত।

উপসংহার

আশা করছি আল্ট্রাসনোগ্রাম রিপোর্ট ছেলে না মেয়ে বোঝার উপায় ধারনা পেয়েছেন এই আর্টিকেলটিতে, এই আর্টিকেলটি পুরোটা পড়ে যদি আপনাদের সামান্যতম উপকারে আসে তাহলে আপনাদের পরিচিতি মানুষদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। আর এ ধরনের বা বিভিন্ন রকমের আর্টিকেল পড়তে আমাদের সাইডে ভিজিট করে দেখুন ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url