চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা জেনে নিন
প্রিয় পাঠক আজকে আমরা জানবো চিয়া সিড একটি গাছের বীজ। শস্যে জাতীয় উদ্ভিদ যা মরুভূমিতেই বেশি জন্মায়। জানা যায়, প্রাচীন অ্যাজটেক জাতির প্রধান খাদ্য তালিকায় এটি রাখা হতো। চিয়া সিড দেখতে অনেকটা তিলের দানার মতো। আমেরিকা ও মেক্সিকোতে চিয়া নামে এক ধরনের গাছ হয়। এই গাছের বীজকেই চিয়া সিড বলে।
ভূমিকা
বর্তমান সময়ে মানুষের খাবার নিয়ে সচেতনতা অনেক। প্রতিদিনের খাবারে কি কি পুষ্টিগুণ আছে, আর কি কি খেলে প্রয়োজনীয় ভিটামিন ও পুষ্টি পাওয়া যাবে তা নিয়ে সচেতন অনেকেই। আর তাই নিত্য নতুন খাবারে মনোযোগ সবার।ঠিক তেমনই এক সুপারফুড চিয়া সিড। স্বাস্থ্য সচেতন মানুষের খাবারের তালিকায় এখন বেশ জনপ্রিয় 'চিয়া সিড'।
চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার উপকারিতা
- চিয়া সিড খেলে শরীরের হৃদরোগের ঝুঁকি ও কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। চিয়া সিড রক্তে ব্লাড সুগারের মাত্রা স্বাভাবিক রাখে, যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। এছাড়া চিয়া সিড শরীর থেকে বর্জ্য পদার্থ বের করে, গ্যাসের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে এবং ভালো ঘুম হতে সাহায্য করে। এর পাশাপাশি চুল, ত্বক ও নখ সুন্দর রাখতে সাহায্য করে।
- আমরা আপনাদের বোঝার সুবিধার্থে চিয়া সিডের উপকারিতাগুলো বিস্তারিত বর্ণনা করা হলো
- চিয়া সিডে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে যা আমাদের শরীরকে শক্তিশালী করে।
- ব্লাড সুগার এর মাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
- ডায়াবেটিস এর ঝুঁকি কমায়।
- উচ্চ পরিমাণে ফাইবার, প্রোটিন, স্বাস্থ্যকর চর্বি ও শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
- খাবারের আগ্রহ কমিয়ে দেয়, ক্ষুধা নিবারণ করে ও ওজন কমাতে সাহায্য করে।
- কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন ও ফাইবারের ভালো উৎস হওয়ায় এর পুষ্টি উপাদান শরীরে শক্তি প্রদান করে।
- শরীরের পেশী বৃদ্ধি, ক্ষতি মেরামত ও পেশী পুনরুদ্ধারের জন্য অপরিহার্য একটি প্রোটিনের উপাদান হচ্ছে চিয়া সিড।
- শর্করার মাত্রা শরীরে নিয়মিত প্রবেশের ফলে লম্বা সময় ধরে স্থিতিশীল শক্তির স্তর বজায় রাখে।
- কাজ করার পর ক্লান্তি দূর করতে ও স্ট্যামিনা বাড়াতে বিশেষ ভূমিকা রাখে।
- কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায় ও মলাশয় (colon) পরিষ্কার করে।
- বদহজম থেকে বাঁচায় এবং সঠিকভাবে হজম প্রক্রিয়াতে সাহায্য করে।
- চিয়া বীজ মানব শরীরের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা উন্নত করতে সাহায্য করে।
- কাজে মনোযোগ, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি ও একাগ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে থাকে।
- পুষ্টিবিদদের মতে, স্যামন মাছের চেয়ে চিয়া সিডে প্রায় ৮ গুণ বেশি পরিমাণে ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড রয়েছে।
- এই চিয়া সিড হৃদরোগের ঝুঁকি ও ক্ষতিকর বাজে কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে।
- মুরগির ডিম থেকে ৩ গুণ বেশি পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে চিয়া সিডে যা শরীরের জন্য খুবই উপকারী।
- দুধের চেয়ে চিয়া সিডে ৫ গুণ বেশি ক্যালসিয়াম পাওয়া যায় যা শরীরের হাড়কে মজবুত করে হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা করে।
- হাঁটু ও জয়েন্টের ব্যথা দুর করতে সাহায্য করে।
- এতে থাকা অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট পদার্থ শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে, যা ব্যায়ামের পরে পেশীর ব্যথা ও ক্লান্তি দূর করে।
- এই বীজ ম্যাগনেসিয়াম ও শরীরের শিথিলকরণ প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। ট্রিপ্টোফ্যান একটি অ্যামিনো এসিড যা সেরোটোনিনে রুপান্তরিত হয় এবং মেজাজ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, এবং
- ত্বক, চুল ও নখ সুন্দর রাখতে ও বিশেষভাবে যত্ন নিতে মধু ছাড়া চিয়া সিডের বিকল্প খুব কমই রয়েছে।
চিয়া সিড খাওয়ার অপকারিতা
গবেষকদের মতে, বেশি পরিমাণে চিয়া সিড খাওয়ার ফলে হজমের সমস্যা তৈরি হয়। চিয়া সিড বেশি খেলে স্তন ক্যান্সার এবং প্রোস্টেট ক্যান্সার বাড়িয়ে দেয়। প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকায় পরিমাণ থেকে বেশি চিয়া সিড খেলে পেটের ব্যথার সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। অতিরিক্ত পরিমাণে চিয়া সিড খেলে ওজন অস্বাভাবিকভাবে কমে যেতে পারে যা স্বাস্থ্যের জন্য খারাপ।
চিয়া যেহেতু দেহের রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে, তেমনি পরিমাণমতো না খেলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বাড়িয়ে দেয়। চিয়া সিড কিছু ওষুধের সাথে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। যারা নিয়মিত ওষুধ খান, তারা অবশ্যই ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে চিয়া সিড পরিমাণ অনুসারে খাবেন। অনেকের এই চিয়া বীজে অ্যালার্জি থাকতে পারে।
যদি খাওয়ার পরে ফুসকুড়ি, চুলকানি অ শ্বাসকষ্ট হয় তাহলে বিরত থাকাই ভালো। গর্ভবতী এবং সদ্য মা হওয়া মহিলারা চিয়া সিড খেলে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করে নেওয়া জরুরী।
চিয়া সিড এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
চিয়া সিড বেশি খেলে পেটের সমস্যা দেখা যায়। এটি বেশি খাওয়ার ফলে প্রোস্টেট ক্যান্সার এবং অন্যান্য ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। চিয়া বীজ বেশি খাওয়ার কারণে ওজন অতিরিক্ত মাত্রায় কমে যায়, যার ফলে শরীর দুর্বল হয় ও কাজ করার ক্ষমতা হারায়। এটি যেমন দেহের শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা দেখা যায়।
আমাদের অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো ও সতেজ রাখতে চিকিৎসকরা বিশেষ করে ফাইবারযুক্ত খাবার খাওয়া পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু অতিরিক্ত খাওয়ার ফলে পেটে ব্যথা, গ্যাস, হজম ও ডায়রিয়ার সমস্যা দেখা দিতে পারে। বেশি খেলে পানির ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে ডাক্তাররা সবসময় খাওয়ার সাথে পরিমাণমতো পানি খেতে হবে।
বাচ্চাদের জন্য চিয়া সিড এর উপকারিতা
চিয়া সিডের ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিড বাচ্চাদের ব্রেইনের বিকাশে এবং বৃদ্ধিতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এতে বিদ্যমান সলিউবল ফাইবার শিশুদের কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। দৈনিক চাহিদার প্রায় ৪২% আয়রন এই চিয়া সিডে থাকে। জিঙ্ক, ক্যালসিয়াম, ও ম্যাগনেসিয়াম সমৃদ্ধ হওয়ায় বাচ্চাদের পেশি গঠনে সাহায্য করে এবং সুগার ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
চিয়া সিড খাওয়ার পরিমাণ
চিয়া সিড খাওয়ার পরিমাণ হলো প্রতিদিন ১ থেকে ১.৫ টেবিল চামচ। এই পরিমাণই আমাদের শরীরের পুষ্টির জন্য যথেষ্ট। কারণ, এতে যথেষ্ট পরিমাণে ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড, ফাইবার, প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, জিংক, এবং ফসফরাস রয়েছে যা আমাদের নানা ধরনের রোগ থেকে মুক্তি দেয়।
আসল চিয়া সিড চেনার উপায়
আসল চিয়া সিড সবসময় ফ্রেশ এবং ঝরঝরা হয়ে থাকে। কখনো একটি দানা অন্যটির সাথে লেগে থাকেনা। বালি বা অন্য কোন কিছুর মিশ্রণ থাকবে না এবং পচা বা বাসি গন্ধ করবে না। কালো চিয়া সিড সাধারণত সাদা চিয়া সিডের তুলনায় কালো চিয়া সিড সামান্য বেশি দামি হয়। কেননা, এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের পরিমাণ বেশি থাকে।
চিয়া সিড দিয়ে চুলের যত্ন
বাড়িতে আপনি অনেক সহজেই চিয়া সিডের হেয়ার মাস্ক বানিয়ে নিতে পারবেন। এক গ্লাস পানিতে ১ টেবিল চামচ চিয়া সিড ভিজিয়ে নিন। ভেজানোর পর তা জেলের আকার ধারণ করলে মিশ্রণে ২ চামচ আপেল সিডার ভিনেগার, ৬ চা চামচ নারিকেল তেল এবং অর্ধেক কাপ মধু মিশিয়ে নিন। এরপর মাইক্রোওয়েভে মিশ্রণটি ৩০ সেকেন্ডের জন্য গরম করে নিন।
তৈরি হয়ে গেলে এই হেয়ার মাস্ক ঘরের তাপমাত্রায় এনে চুলে লাগিয়ে ৫-১০ মিনিট রেখে দিন। পরে গোসলের সাথে চুল ধুয়ে ফেলুন। আপনি চাইলে শ্যাম্পুও করতে পারেন। এভাবে সপ্তাহে অন্তত ১ দিন করে চিয়া সিডের হেয়ার মাস্কটি ব্যবহার করতে পারেন। চুলের যত্নের ক্ষেত্রে চিয়া সিডের হেয়ার মাস্ক খুব ভালো কাজ করে যা ডিপ কন্ডিশনিং এর কাজ করে।
চিয়া সিড কারা খেতে পারবে না
- যাদের নিম্ন রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে, তারা চিয়া সিড খেলে শরীরের রক্ত পাতলা করে দেয়। ফলে এড়িয়ে চলাই ভালো। এছাড়া, এতে থাকা ওমেগা ৩ ফ্যাটি এসিডও রক্তকে পাতলা করে দেয়। চিয়া সিড খেলে রক্তে চিনির পরিমাণও কমে যায়।
- ফলে রক্তে শর্করার পরিমাণ কমাতে সাহায্য করে। কিন্তু, একেবারে কমে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে বিধায় যারা নিয়মিত ইনসুলিন নেন, তারা চিয়া সিড খেতে পারবে না।
ত্বকের যত্নে চিয়া সিড
ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখার সাথে সাথে চিয়া সিড মুখে বয়সের ছাপ পড়া আটকে দিতে পারে। ত্বককে উজ্জ্বল করতে ওমেগা- ৩ ফ্যাটি এসিড খুবই প্রয়োজনীয়, যা চিয়া সিডে রয়েছে। চিয়া সিডে ভিটামিন ই, অ্যান্টিঅক্সিড্যান্ট উপাদান ত্বককে নানা দুষিত পদার্থ ও কোষের ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও এতে অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ।
উপাদান ত্বকের প্রদাহজনিত সমস্যা দূর করতে বিশেষ সাহায্য করে। যাদের মুখে ব্রণের সমস্যা রয়েছে, তারা এই ভেজানো চিয়া সিড মুখে মাখলে বা নিয়মিত খেলে ভালো উপকার পাবেন।
গর্ভাবস্থায় চিয়া সিড খাওয়া যাবে কি?
- হ্যাঁ। গর্ভাবস্থায় অবশ্যই চিয়া সিড খাওয়া যাবে। একজন গর্ভবতী মহিলার সুস্থ থাকতে দিনে প্রায় ৬৫৯ মিলিগ্রাম ওমেগা- ৩ ফ্যাটি এসিড দরকার।
- যদিও মাছ, আখরোট, এভোকাডো খেলে ঘাটতি পূরণ হয়, কিন্তু চিয়া সিড খেলে অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের পাশাপাশি ফলিক এসিডও পাবেন যা খুবই উপকারী।
- কেননা, এই ফলিক এসিড সময়ের আগে শিশু জন্মানোর আশঙ্কা কমায়, জন্মগত ত্রুটি রোধ করে এবং শিশুর ওজন বাড়াতে সাহায্য করে
উপসংহার
আশা করছি চিয়া সিড এর উপকারিতা ও অপকারিতা জেনে নিন ধারনা পেয়েছেন এই আর্টিকেলটিতে, এই আর্টিকেলটি পুরোটা পড়ে যদি আপনাদের সামান্যতম উপকারে আসে তাহলে আপনাদের পরিচিতি মানুষদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। আর এ ধরনের বা বিভিন্ন রকমের আর্টিকেল পড়তে আমাদের সাইডে ভিজিট করে দেখুন ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url