জাল দলিল চেনার উপায় – জাল দলিল বাতিল করার নিয়ম

প্রিয় পাঠক জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে সাবধান না হলে পরবর্তীতে দীর্ঘদিন ভুগতে হয়। এমন বহু মানুষ রয়েছেন, জমি কেনা-বেচার ক্ষেত্রে আসল দলিল চিনতে না পারায় ঝামেলায় পড়েন। এজন্য দলিল চেনা খুবই জরুরি। চলুন দেখে নিই ঠিক কি বিষয় দেখতে হবে। এখনও যদিও পর্চা/ খতিয়ান অনলাইনেই চেক করা যায়। নামজারিও অনলাইনে যাচাই করা যায়।
জাল দলিল চেনার উপায় – জাল দলিল বাতিল করার নিয়ম
ভুয়া তথ্য দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি তৈরি করে, নকল কাগজপত্রের মাধ্যমে করা হয় জমি বা ফ্ল্যাটের ভুয়া দলিল। তারপর এসব দলিল বিভিন্ন ব্যাংকে রেখে নেওয়া হয় মোটা অংকের ঋণ। এইভাবে কাজকর্ম করে, এমন বেশ কয়েকটি চক্র

ভূমিকা

ভুয়া নথিপত্র বা জালিয়াতির মাধ্যমে এনআইডি যারা তৈরি করে সেই চক্রের প্রথম ও প্রধান টার্গেট থাকে জমি দখল বা জাল দলিল তৈরি। এক্ষেত্রে জালিয়াতি চক্রের প্রথম টার্গেট হয় দামি ও পতিত জমি। যখন কোনও জমির দীর্ঘদিন ধরে খাজনা দেওয়া হয় না, কিংবা জমিতে কেউ থাকে না তখন সেই জমির মূল মালিকের একটি ভুয়া এনআইডি তৈরি করা হয়। তারপরই সেই জমি বিক্রি ও দখলের উদ্যোগ নেওয়া হয়।

জাল দলিল চেনার উপায়

আপনারা অনেকেই জানতে চেয়েছেন যে জাল দলিল চেনার উপায় কি? মূলত সেজন্যই আমরা শুধু মাত্র আপনাদের সুবিধার কথা ভেবেই আজকের পোষ্টের এই পাঠে জাল দলিল চেনার উপায় গুলো বিস্তারিত জেনে নিব। আপনি যদি জাল দলিল চেনার উপায় জেনে না থাকেন, তাহলে এই অংশ টুকু মনযোগ দিয়ে পরে বিস্তারিতভাবে জেনে নিন। জাল দলিল চেনার উপায় নিচে উল্লেখ করে হল।

দলিল নম্বর দেখে জাল দলিল নির্ণয়

দলিলের প্রথম পাতায় উপরের দিকে মূলত বামে একটি এবং ডানে আরেকটি নাম্বার থাকে। ডান দিকের নাম্বারটি বাম দিকের নাম্বার চেয়ে ছোট হয়ে থাকে; ডানদিকে ৪৮৯৩ থাকলে বামদিকে তার থেকে বড় সংখ্যা হবে যেমন ৪৯৩৮। বামদিকের সংখ্যাকে দলিলের ক্রমিক নাম্বার হিসেবে পরিচিত এবং ডান দিকের সংখ্যাক দলিল নাম্বার হিসেবে পরিচিত।

ডান দিকের নাম্বার বাম পাশের তুলনায় বড় অলে সেটি উক্ত দলিলটি জাল হিসেবে একটি সন্দেহের অবকাশ ঘটতে পারে।

দলিলদাতার স্বাক্ষর ও টিপসই যাচাই করে

  • দলিল দাতার সাক্ষর এবং টিপসই পরীক্ষা করে জালিয়াতি নির্নয় করা যায়। এর জন্য বিজ্ঞ আদালতে আবেদন করতে হয়। আবেদন করা হলে যার হাতের লেখা, টিপসই বা সাক্ষর বলে দাবি করা হচ্ছে তাকে নোটিস দিতে হয়। তারপর, উক্ত ব্যক্তির লেখা, সাক্ষর বা টিপসই নেওয়া হয়।
  • যদি মৃত্যু বা অন্য কোন কারনবশত দলিলে স্বাক্ষরকারীকে পাওয়া না তাহলে সেক্ষেত্রে উক্ত ব্যক্তির আগের কোন স্বাক্ষর কিংবা টিপসই অন্য দলিল থেকে কালেক্ট করে সেটা আবার বিশেষজ্ঞের পরীক্ষার জন্য পাঠিয়ে দলিলটি জাল কিনা সে সিদ্ধান্তে পোঁছানো যায়।
দলিল লেখার ফরমেট নির্ণয়
বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬০ সালের পর থেকে দশমিক পদ্ধতির হিসাব পরিচালনা করা হয় এবং এর পাশাপাশি ১৯৬০ সালের আগের কোন জমির দলিলে যদি দশমিক পদ্ধতিতে জমির হিসাব খাজনার পরিমান উল্লেখ করা থাকে তাহলে সীক্ষেত্রে উক্ত জমির দলিলটি জাল হিসেবে গন্য করা হবে।
কোন রেজিষ্ট্রি দলিল নিয়ে সন্দেহ থাকলে ।

কিংবা সন্দেহ জনক মনে হলে সেক্ষেত্রে আপনাকে তর্কিত রেজিষ্ট্রি দলিলটি সম্পাদন করার সময় সেই অঞ্চলে যিনি সাব-রেজিষ্ট্রার ছিলেন তাকে খুজে বের করে নিয়ে তিনি আগে যেই দলিলে স্বাক্ষর করেছিলেন সেটি কালেক্ট করে সেটার সাথে ভালোমত পরিক্ষা নিরীক্ষার মাধযমেমিলিয়ে দেখে জাল দলিল নির্ণয় করা যায়।

দলিলে লিখিত বিভিন্ন ভাষা বা শব্দ যাচাই

‘ভূমি উন্নয়ন কর’ শব্দটি আসলে ১৯৭৬ সালে অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পরে এক বিশেষ বিবেচনায় ভূমি ব্যবস্থাপনায় ব্যবহার করা হয়ে থাকে। তবে একটি মূখ্য বিষয় হচ্ছে ‘ভূমি উন্নয়ন কর’ শব্দটি যদি ১৯৭৬ সালের আগের দলিলে লিখে তা বরাবরের মতো পরিত্রান করার কথা উল্লেখ থাকে তাহলে উক্ত জমির দলিলটি জাল হিসেবে গন্য বা বিবেচিত হবে।

লিখিত দলিলটির মালিকানা যাচাই

সন্দেহকৃত দলিলে যদি বিভিন্ন দলিল বা খতিয়ানের রেফারেন্স দেওয়া থাকে তাহলে উক্ত দলিল বা খতিয়ান পর্যালোচনার মাধ্যমে মালিকানা হস্তান্তরের ধারাবাহিক বিবরণ পাওয়া যায়। এক্ষেত্রে তর্কিত দলিলের সহিত বায়া দলিলের মালিকানা হস্তান্তরের বিবরনের সামঞ্জস্য না থাকলে দলিলটি জাল দলিল হিসেবে গন্য করার অবকাশ থাকে।

বালাম বই বা রেজিস্টার যাচাই

দলিলের রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে সন্দেহের উদ্বেগ হলে রেকর্ড রুমে তল্লাশীর মাধ্যমে দলিলটি রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে কি হয় নাই তা জানা যায়। তল্লাশীর মাধ্যমে বালাম বহিতে যদি দলিলটির রেজিষ্ট্রেশন নিয়ে কোন তথ্য না থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে উক্ত দলিলটি জাল হিসেবে বিবেচনা করা হবে।

বর্তমান সময়ে দলিলে যে ছবি থাকে তা যাচাই করা

  • কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা হয় যে, যিনি কোন দলিল নকল বা জাল করে তখন মূল দলিলে ক্রেতা বিক্রেতার গ্রহীতার নাম, ঠিকানা এবং অন্যান্য বিবরণ ঠিক ঠাক রেখে শুধুমাত্র ক্রেতা বিক্রেতার ছবি পরিবর্তন করে থাকে। শুধু অন্য একজনের ছবি সংযুক্ত করে বাকি সব হুবুহু সৃজন করে।
  • আপনি যখন দলিলটি তল্লাশি দিবেন তখন মুল দাতা-গ্রহীতার নাম, ঠিকানা সবই সঠিক পাবেন এবং দলিলটি যে জাল সেটি সনাক্ত করতে পারবেন না। এক্ষেত্রে দলিলে সংযুক্ত ব্যক্তিটির ঠিকানা এবং তার ছবিটি ভুল রয়েছে কিনা সেটা আপনাকে পরিস্কার ভাবে যাচাই বা অনুসন্ধান করে নিতে হবে।
  • উপরোক্ত বিষয়গুলো আপনাকে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে। কোন জমি ক্রয় করার পূর্বে আপনাকে উক্ত বিষয়গুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখে নিতে হবে আশা করা যায় তাহলে আপনার জমি ক্রয় করা সম্পূর্ণরূপে সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তো আশা করছি আপনারা এই অংশ থেকে জাল দলিল চেনার উপায় জানতে পেরেছেন। এবার চলুন, জাল দলিল বাতিল করার নিয়ম জেনে নেই।

আসল দলিল চেনার উপায় ২০২৫-ভূমি বা সম্পত্তি কেনার ক্ষেত্রে যা যা দেখতে হবে

  1. রেজিস্ট্রি কার্যক্রম শেষ হয়ে থাকলে সংশ্লিষ্ট রেজিস্ট্রি অফিসে বা জেলা সদরের রেকর্ড রুমে সংরক্ষণ করা বালাম বহির সাথে দলিলটি মিলিয়ে দেখতে হবে।
  2. সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিস থেকে সংশ্লিষ্ট দলিলে উল্লিখিত জমির মিউটেশন বা নামজারি সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে।
  3. সংশ্লিষ্ট দলিলে উল্লিখিত জমির মাঠপর্চাও যাচাই করতে হবে। এক্ষেত্রে উপজেলা সেটেলমেন্ট অফিসারের কার্যালয়ে গিয়ে নির্দিষ্ট ফিস প্রদান করে আবেদনের মাধ্যমে মাঠপর্চা উঠিয়ে যাচাই করতে হবে। সংশ্লিষ্ট জমির মাঠপর্চা অন্য ব্যক্তির নামে হলে সেখানে জাল-জালিয়াতি আছে মর্মে ধরে নিতে হবে।
  4. দলিলটি “হেবার ঘোষণাপত্র” বা “দানের ঘোষণাপত্র” হলে সেক্ষেত্রে দাতা-গ্রহিতার মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক পরীক্ষা করতে হবে।
  5. মূল মালিকের স্বাক্ষর নকল করে জাল দলিল তৈরি হতে পারে। এ ক্ষেত্রে স্বাক্ষর বিশেষজ্ঞের মাধ্যমে স্বাক্ষরের সত্যতা যাচাই করতে হবে।
  6. রেজিস্ট্রি অফিসের সীল জাল করে জাল দলিল তৈরি হলে প্রয়োজনে রেজিস্ট্রি অফিসে গিয়ে বিভিন্ন সীল পরীক্ষা করতে হবে।
  7. সম্প্রতি রেজিস্ট্রি করা কোন দলিলের সনদপ্রাপ্ত দলিল লেখককে জিজ্ঞাসা করেও জাল দলিল সনাক্ত করা যেতে পারে।
  8. দলিলটি সাম্প্রতিক রেজিস্ট্রিকৃত পাওয়ার অব অ্যাটর্ণি দলিল হলে সেটি নির্দিষ্ট ফরমেটে প্রস্তুত কিনা যাচাই করুন। কারন বর্তমানে ১৯ টি কলামে দলিলটি প্রস্তুতের বিধান রয়েছে।
  9. আইন ও বিধি সম্মতভাবে পাওয়ারদাতা কর্তৃক পাওয়ার অব অ্যাটর্নি বা আমমোক্তারনামা দলিল বাতিল করার পরও পাওয়ার গ্রহিতা বা অ্যাটর্নি কর্তৃক কোন দলিল সম্পাদন এবং রেজিস্ট্রি করালে দলিলটি জাল বলে গন্য হবে।
  10. সি,এস, জরিপ পরবর্তী সময়ে জমিটি যতবার বিক্রি বা অন্যভাবে হস্তান্তর হয়েছে, তার সঙ্গে জমির পরিমাণ মিল আছে কি-না, তা যাচাই করুন।
  11. স্টাম্প-ভেন্ডারগণ এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট রেজিস্টার বহিতে স্টাম্প ক্রেতার নাম লিখে রাখেন এবং স্টাম্পে নির্দিষ্ট নম্বর ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে স্টাম্প ভেণ্ডারের মাধ্যমে স্টাম্প ক্রেতার নাম ও ব্যবহৃত নম্বর পরীক্ষা করে জাল দলিল সনাক্ত করা যায়।

জাল দলিল বাতিল করার নিয়ম

  • জাল দলিল বাতিল করার সঠিক নিয়ম হচ্ছে মূলত জাল দলিল প্রমানিত হওয়ার সাথে সাথে সেই দলিল বাতিল করার জন্য খুব বেশি দেরি না করে দেওয়ানি আদালতে মামলা দায়ের করে ফেলতে হবে। আপনার দলিল জাল প্রমানিত হওয়ার পরে এই মামলা তামাদি আইনের ১ম তফসিলের ৯১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আগামী তিন বছরের মধ্যে করা যাবে।
  • দলিল জালকারীকে দণ্ডবিধির ৪৬৩-৪৭৩ ধারা মোতাবেক তার বিরুদ্ধে একটি ফৌজদারি মামলা করা যাবে। আর উক্ত জাল দলিল বাতিল করতে হলে আপনি চাইলে ১৮৭৭ এর ধারা মোতাবেক শাস্তি হিসেবে তার বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা করতে পারবেন।
  • দলিল বাতিলের সঙ্গে সম্পত্তির দখল পাবার মামলাও করা যায়। আদালত দলিল বাতিলের আদেশ/রায় প্রদান করলে ডিক্রির একটি কপি সংশ্লিষ্ট সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে প্রেরণ করবেন। উক্ত কপির আলোকে রেজিস্ট্রি অফিস দলিল বাতিলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট বালাম বহিতে লিপিবদ্ধ করে রাখবেন।

উপসংহার

আশা করছি জাল দলিল চেনার উপায় – জাল দলিল বাতিল করার নিয়ম ধারনা পেয়েছেন এই আর্টিকেলটিতে, এই আর্টিকেলটি পুরোটা পড়ে যদি আপনাদের সামান্যতম উপকারে আসে তাহলে আপনাদের পরিচিতি মানুষদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। আর এ ধরনের বা বিভিন্ন রকমের আর্টিকেল পড়তে আমাদের সাইডে ভিজিট করে দেখুন ধন্যবাদ।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url