একাদশী পালন করার নিয়ম কি - একাদশীর খাদ্য তালিকা
প্রিয় পাঠক আমরা জানবো একাদশী পালন করার নিয়ম কি - একাদশীর খাদ্য তালিকাহিন্দু শাস্ত্র অনুযায়ী, একাদশী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তিথি। মনে করা হয়, এই ব্রত পালন করলে সমস্ত পাপ কাজ থেকে ব্যক্তি মুক্তি পেতে পারে। প্রতি মাসেই দুটি করে একাদশী তিথি পড়ে। একটি শুক্লপক্ষে এবং অন্যটি কৃষ্ণপক্ষে। এক একটি একাদশী এক এক নামে পরিচিত।
ভূমিকা
একাদশীর মূল কাজ হল– নিরন্তর ভগবানকে স্মরণ করা। তাই আপনারা যে নিয়মে, যে সময়ে পালন করুন না কেন, ভগবানকে ভক্তিভরে স্মরণ করাই যেন আপনারই মূল কাজ হয়। বছরে ২৪টি একাদশী হয়। অধিকমাস থাকলে ২৬টি একাদশী দেখা যায়। একাদশী ব্রতে বিষ্ণুর আরাধনা করা হয়। নিয়ম মেনে এই ব্রত পালন করলে ব্যক্তির সমস্ত কষ্ট দূর হয়, পরিবারে সুখ-সমৃদ্ধি আসে।
একাদশী পালন করার নিয়ম
প্রথমত একাদশী তিথিতে খুব তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে, যদি ব্রহ্ম মুহূর্তে ঘুম থেকে উঠতে পারেন তাহলে খুবই ভালো।সকালে উঠেই স্নান করুন এবং পরিষ্কার কাপড় পরে এই ব্রত পালনের সংকল্প গ্রহণ করুন।যতক্ষণ আপনি উপবাস পালন করবেন ততক্ষণ ব্রহ্মচর্য বজায় রাখুন।পেঁয়াজ, রসুন, মাংস, মাছ, চাল, গম, মুসুর ডাল এবং ডাল খাওয়া যাবে না এই দিন।
অ্যালকোহল এবং নেশা জাতীয় বিভিন্ন দ্রব্য এড়িয়ে চলতে হবে।উপবাস পালন করলে ফল, দুধ, সাবুদানার খিচুড়ি, পুরি অথবা পরোটা, লুচি ইত্যাদি খেতে পারেন।গরিব-দুঃখীদের মধ্যে খাদ্য এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র দান করতে পারেন আপনার সাধ্য অনুসারে।সারাদিন “ওম নমঃ ভাগবতে বাসুদেবায় নমঃ” এই মন্ত্র জপ করুন।
একাদশী তিথিতে পূজা করার পর বিষ্ণুর সহস্রনাম, ভগবান বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা স্তোত্র এবং আমলকী একাদশীর ব্রতকথা পাঠ করুন।একাদশী হল হিন্দু পঞ্জিকা অনুসারে মাসের শুক্ল ও কৃষ্ণ পক্ষের একাদশতম চান্দ্র দিন (তিথি)।প্রতিটি একাদশীর সময় চাঁদের অবস্থান অনুসারে নির্ণয় করা হয়। এটি হিন্দুধর্মের বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে জনপ্রিয়ভাবে পালিত হয়।
অনুগামীরা উপবাস করে বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উপাসনা করে। বছরে সাধারণত ২৪টি একাদশী থাকে, এবং কখনও কখনও অধিবর্ষে দুটি অতিরিক্ত একাদশী হয়। ভাগবত পুরাণ বিষ্ণুর ভক্ত অম্বরীষের একাদশী পালনের কথা উল্লেখ করেছে। একাদশী পুণ্যতিথি হিসেবে বিবেচিত। হিন্দুধর্মের, একাদশীর উপবাসের প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল মন ও শারীরিক ইন্দ্রিয়গুলির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভ করা ।
এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির দিকে পরিচালিত করা। এছাড়াও, উপবাসের সাথে যুক্ত বেশ কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে।একাদশীর দিন সূর্যোদয় থেকে পরের দিন সূর্যোদয় পর্যন্ত এই বিরতির সময়কাল উচ্চ প্রোটিন ও কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার যেমন মটরশুঁটি এবং রবিশস্যের পরিবর্তে শুধুমাত্র ফল, শাকসবজি ও দুগ্ধজাত পণ্য খাওয়া হয়।
একাদশীতে নিষিদ্ধ বিষয়াবলী
- একাদশী ব্রতের আগের দিন রাত ১২ টার আগেই অন্ন ভোজন সম্পন্ন করে নিলে সর্বোত্তম।
- ঘুমানোর আগে দাঁত ব্রাঁশ করে দাঁত ও মুখ গহব্বরে লেগে থাকা সব অন্ন পরিষ্কার করে নেওয়া সর্বোওম । সকালে উঠে শুধু মুখ কুলি ও স্নান করতে হয়।
- একাদশীতে সবজি কাটার সময় সতর্ক থাকতে হবে যেন কোথাও কেটে না যায় । একাদশীতে রক্তক্ষরণ বর্জনীয় । দাঁত ব্রাশঁ করার সময় অনেকের রক্ত ক্ষরণ হয়ে থাকে । তাই একাদশীর আগের দিন রাতেই দাঁত ভালো ভাবে ব্রাশঁ করে নেওয়াই সর্বোওম ।
- একাদশীতে চলমান একাদশীর মাহাত্ন্য ভগবদ্ভক্তের শ্রীমুখ হতে শ্রবণ অথবা সম্ভব না হলে নিজেই ভক্তি সহকারে পাঠ করতে হয় ।
- যারা একাদশীতে একাদশীর প্রসাদ রান্না করেন , তাদের পাচঁ ফোড়ঁন ব্যবহারে সতর্ক থাকা উচিৎ । কারণ পাঁচ ফোড়ঁনে সরিষার তৈল ও তিল থাকতে পারে যা বর্জনীয় ।
- একাদশীতে শরীরে প্রসাধনী ব্যবহার নিষিদ্ধ । তৈল ( শরীরে ও মাথায় ) সুগন্ধি সাবান শ্যাম্পু ইত্যাদি বর্জনীয় ।
- সকল প্রকার ক্ষৌরকর্ম — শেভ করা এবং চুল ও নক কাটা নিষিদ্ধ
একাদশীতে কি কি খাওয়া নিষিদ্ধ
একাদশীতে পাচঁ প্রকার খাদ্য গ্রহণ করতে নিষেধ করা হয়েছে
- ধান জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – চাউল, মুড়ি, চিড়া, সুজি, পায়েশ, খিচুড়ি, চাউলের পিঠা, খৈ ইত্যাদি।
- গম জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন – আটা,ময়দা, সুজি , বেকারীর রূটি , বা সকল প্রকার বিস্কুট ,হরলিকস্ জাতীয় ইত্যাদি ।
- যব বা ভূট্টা জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — ছাতু , খই , রূটি ইত্যাদি ।
- ডাল জাতীয় সকল প্রকার খাদ্য যেমন — মুগ মাসকলাই , খেসারী , মসুরী, ছোলা অড়রহ , ফেলন, মটরশুটি, বরবটি ও সিম ইত্যাদি ।
- সরিষার তৈল,সয়াবিন তৈল, তিল তৈল ইত্যাদি। উপরোক্ত পঞ্চ রবিশস্য যেকোন একটি একাদশীতে গ্রহণ করলে ব্রত নষ্ট হয় ।
একাদশীতে কি কি খাওয়া যাবে
নির্দিষ্ট কিছু শাকসবজি, যেমন
- কুমড়া, লাউ, শশা ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে।
- মাখানা, ফক্স ,নাটস মাখানা ভাজা বা মাখানার খিচুড়ি খাওয়া যেতে পারে।
- নারকেল, কুচি করা বা গোটা নারকেল খাওয়া যায়, যা উপবাসের জন্য উপযুক্ত।
- ডাবের পানি, হাইড্রেট থাকার জন্য ডাবের পানি খুবই উপকারী।
- পানীয়ঃ দুধ, সরবত, ফলের রস এবং পানি খাওয়া যায়।ফলমূল একাদশীর দিনে বিভিন্ন ধরনের ফল খাওয়া যায়। যেমনঃ কলা, আপেল, আঙুর, পেঁপে, আম ইত্যাদি।
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারঃ দুধ, দই, মাখন, ঘি ইত্যাদি খাওয়া যায়।
- সাবু দানাঃ সাবু দানার খিচুড়ি বা পায়েস তৈরি করে খাওয়া যায়।
- সিঙ্গাড়া আটা (কুটু আটা) একাদশীর জন্য সিঙ্গাড়া আটার (বকউইট ফ্লাওয়ার) রুটি বা পরোটা তৈরি করা যায়।
- আলুঃ সিদ্ধ আলু বা ভাজা আলু খাওয়া যায়, তবে এতে মশলা কম ব্যবহার করা হয়।
- গোল আলু, মিষ্টি আলু, চাল কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, পেঁপে, টমেটো, ফুলকপি ইত্যাদি সবজি ঘি বা বাদাম তেল দিয়ে রান্না করে ভগবানকে ভোগ নিবেদন করে আহার করতে পারেন ।
একাদশী করলে কি কি ফল খাওয়া যায়
একাদশীর উপবাসে বিভিন্ন ধরনের ফল খাওয়া যায়, যেগুলো সহজপাচ্য এবং শরীরের জন্য পুষ্টিকর। নিচে একাদশীর উপবাসে খাওয়া যায় এমন কিছু ফলের তালিকা নিম্নে দেওয়া হলোঃ
- কলা
- আপেল
- পেয়ারা
- আঙুর
- পেঁপে
- কমলা লেবু
- আনারস
- ডাবের শাঁস
- আম
- বেদানা -ডালিম
একাদশীতে কি সাবু খাওয়া যায়
কাদশীর উপবাস ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। উপবাসের সময় ভক্ত আটা, চিনি,সাবু, বাদাম, নারকেল, মিষ্টি আলু, কালো গোলমরিচ, শিলা লবণ, ইত্যাদি খেতে পারেন।
একাদশী পারন মন্ত্র
অনেকেই একাদশীতে, একাদশী পারন করে থাকেন, কিন্তু অনেকেই একাদশীর পারন মন্ত্র জানেন না একাদশী করার সময় আপনি এই মন্ত্রটি পাঠ করে একাদশীর পারন করতে পারেন জেনে নিন
- একাদশ্যাং নিরাহারো ব্রতেনানেন কেশব।
- প্রসীদ সুমুখ নাথ জ্ঞানদৃষ্টিপ্রদো ভব।।”
একাদশীর সময় এই মন্ত্র পাঠ করে নির্দিষ্ট সময়ের মাঝে পারন করতে হয়।
নির্জলা একাদশী পালনের সঠিক নিয়ম
নির্জলা একাদশী হলো হিন্দু সনাতন ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং মুক্তি প্রদানকারি উপবাস, এই একাদশীকে হিন্দু ধর্মের সব ব্রতের মধ্যে সর্বোত্তম ব্রত বলে গণ্য করা হয়, এই একাদশী জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্ল পক্ষের দিন পালন করা হয়।”নির্জলা” শব্দের অর্থ হলো “জলহীন,” অর্থাৎ এই দিনটি ভক্তরা সম্পূর্ণরূপে আহার ও জল পরিত্যাগ করে উপবাসটি পালন করেন।
ভগবান বিষ্ণুর প্রতি গভীর ভক্তি ও শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে নির্জলা একাদশী পালন করা হয়। এই উপবাসের মাধ্যমে ভক্তরা শারীরিক ও মানসিক শুদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি পাপ থেকে মুক্তি ও ঈশ্বরের কৃপা লাভের জন্য এই একাদশী উপবাস করেন। হিন্দু ধর্ম গ্রন্থে নির্জলা একাদশীর মহিমা সম্পর্কে বিস্তার ভাবে বর্ণিত আছে, সেখানে বলা হয়েছে।
যে এই একাদশী উপবাস বিধি সম্মত ও নির্ভুল ভাবে করলে, সারা বছরের, সমস্ত একাদশীর সমান ফল প্রাপ্ত করা যায়।তাই ভক্তরা প্রার্থনা, জপ, ও কীর্তনের মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করেন। হে ভক্ত তাই আসুন শ্রীহরির প্রিয় ও ভক্তির জন্মদাতা এবং সর্ব পাপ হরন করি, এই নির্জলা একাদশী ব্রত পালনের সঠিক নিয়ম ও পদ্ধতি জেনে অধাতিক পথে অগ্রসর হই।
একাদশী পালনের উপকারিতা
একাদশী ব্রত পালনের উপকারিতা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর লীলাবিলাসের প্রথম থেকেই একাদশীর উপবাসের প্রথা প্রবর্তন করেছিলেন, শ্রীলজীব গোস্বামী তাঁর ভক্তি সন্দর্ভ গ্রন্থে স্কন্দ পুরানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন "যে মানুষ একাদশীর দিন শস্যদানা গ্রহণ করে সে তার পিতা মাতা ভাই গুরু হত্যাকারী এবং সে যদি বৈকুন্ঠলোকেও উন্নীত হয় ।
তবুও তার অধঃপতন ঘটে, একাদশীর দিনে শ্রীবিষ্ণুর জন্য সবকিছু রন্ধন করা হয় এমনকি অন্ন ডাল কিন্তু শাস্ত্রে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যে সেদিন বৈষ্ণবদের শ্রীবিষ্ণুর প্রসাদ পর্যন্ত গ্রহণ করা উচিত নয়, সেই প্রসাদ পরের দিন গ্রহণ করার জন্য রেখে দেওয়া যেতে পারে, একাদশীর দিনে কোনোরকম শস্যদানা এমনকি অন্ন--তা যদি শ্রীবিষ্ণু প্রসাদও তবুও গ্রহণ করতে ।
- কঠোরভাবে নিষেধ করা হয়েছে, বিধবা না হলেও শাস্ত্র অনুসারে একাদশীর ব্রত পালন করার প্রথা শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু প্রবর্তন করেছিলেন, ভক্তি সহকারে একাদশী ব্রত পালন করলে সকল যজ্ঞ ও সকল প্রকার ব্রত পালনের ফল লাভ হয়ে থাকে, এই তিথিতে অন্ন গ্রহণকারীকে পশুর থেকেও নিকৃষ্ট বলে শাস্ত্রে বর্ণনা করা হয়েছে, অনেকের ধারনা শ্রীপুরীধামে শ্রীজগন্নাথের ।
- অন্ন প্রসাদ ভক্ষণ দোষবহ নয়, এই ধারণার বশবর্তী হয়ে পুরীতে অনেকেই নিঃসঙ্কোচে অন্ন প্রসাদ গ্রহণ করে এটি সম্পূর্ণ শাস্ত্রবিরুদ্ধ বিচার, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর সধবা জননী শ্রীশচীদেবীকে এই ব্রত পালন করতে অনুরোধ করেছিলেন, একাদশী তিথিতে নিরম্বু উপবাস করাই শ্রেয়, কিন্তু যারা উপবাস করতে একেবারেই অসমর্থ তারা একাদশীর প্রসাদ রুপে ।
অল্প পরিমাণে ফল আলুর সবজি দুগ্ধজাত খাদ্য গ্রহণ করতে পারেন, সারাদিন হরিভক্ত সঙ্গে শ্রীভগবানের নাম কীর্তন রুপ গুন- লীলাদি- শ্রবণ-স্মরণাদি করতে হয় এবং রাতে জাগরণ ও সুমধুর হরিকথা শ্রবণ করা প্রয়োজন, একাদশী ব্রত পালনের সময়ে পরনিন্দা পরচর্চা মিথ্যাভাষণ ক্রোধ দূরাচারী দর্শন সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ, একাদশী তিথিতে ধান ।
- গম ভুট্টা ও সরিষা জাতীয় যাবতীয় খাদ্য বর্জনীয়, এই তিথিতে সমস্ত পাপ এই পঞ্চ শস্যের ভিতর অবস্থান করে, শসা জাতীয় প্রসাদ গ্রহণ করে একাদশীর পারণ করা একান্ত দরকার, নতুবা একাদশীর ফল লাভ হয় না।
লেখকের শেষ কথা
আশা করছি একাদশী পালন করার নিয়ম কি - একাদশীর খাদ্য তালিকা ধারনা পেয়েছেন এই আর্টিকেলটিতে, এই আর্টিকেলটি পুরোটা পড়ে যদি আপনাদের সামান্যতম উপকারে আসে তাহলে আপনাদের পরিচিতি মানুষদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। আর এ ধরনের বা বিভিন্ন রকমের আর্টিকেল পড়তে আমাদের সাইডে ভিজিট করে দেখুন ধন্যবাদ।
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url